” ঘোড়া ” একটি জ্বীন এর গল্প ( পর্ব ১ )



প্রায় সপ্তাহ দুই আগে আমার আদি বাড়িতে গিয়েছিলাম। বাড়ীটা প্রায় ৩০ বছরের উপর পরিত্যাক্ত অবস্থায় আছে।একজন বৃদ্ধ কেয়ার টেকার আছেন ঠিকই,কিন্তু কিছু কিছু ঘর প্রায় একশ বছরের উপর বন্ধ অবস্থায় ছিল। বাড়িটা প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো বলে জানি। কি ধরণের মেরামত করলে বাড়িটাকে আরও কিছু বছর টিকিয়ে রাখা যায় সেটা দেখার জন্যই ওখানে গিয়েছিলাম । বন্ধ ঘরগুলো খোলার প্রয়োজন হয়েছিল সেই কারণেই।ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের ঘরটা যখন খুললাম, ঘরের এক কোণে একটা সিন্দুক পেলাম। আমার দেখা সিন্দুক্গুলো থেকে একেবারেই ভিন্ন ধরণের। সিন্দুকটা বেশ পুরোনো আর প্রয়োজনের তুলনায় অরিরিক্ত মজবুত। অবশ্য এটাও ঠিক যে সিন্দুক কতটুকু মজবুত হবে তার কোনো মাপকাঠি নেই।



Marean Feisal‎


বিশ্বস্ত কিছু লোক নিয়ে সিন্দুকটা ভেঙ্গে ফেললাম। দেখলাম, মাত্র একটা ঘড়া রয়েছে সিন্দুকটার ভিতর। বৃদ্ধ কেয়ার টেকার ওটাতে হাত দিতে মানা করেছিল।বলেছিল, ছোট আম্মা, ওটা যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিন । আপনার নানীজানের মুখে এই সিন্দুকটা সম্পর্কে খুব একটা ভালো কথা শুনি নাই। দরকার নেই এই ঘর মেরামত করার। আপনি ঘড়াটা সিন্দুকেই থাকতে দিন, আর সিন্দুকটা আবার লোহার পাত দিয়ে আটকে দেই, তারপর দরজায় আবার আগের মত তালা লাগিয়ে দেই।’

আমি শুনিনি বৃদ্ধের কথা। বলেছিলাম, ‘এত ভয় পাওয়ার কিছু নাই, আর আমি নিজেই এখন নানীজান।’

যাইহোক, বাড়ি মেরামতের জন্য লোক লাগিয়ে যথারীতি ঢাকায় ফিরে এসেছি। )


নিজের বাড়িতে ফিরে ঘড়াটা নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়লাম, সবার অগোচরে কি করে লুকিয়ে রাখব, কোথায় রাখব ভেবে পাচ্ছিলাম না; অবশেষে চিলেকোঠাটাকেই বেশ নিরাপদ মনে হল। চিলেকোঠার চাবি আমার কাছেই থাকে, সুতরাং ভয়ের কিছু নেই।

ঘড়াটাতে কি আছে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল, অবশেষে গত বুধবার রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি ঘড়ার শীল গালা ভেঙ্গে ফেললাম আর তখন থেকেই ঘটনার শুরু।



ঢাকনাটা খুলতেই কালচে নীল একটা ধোঁয়া কুণ্ডুলী পাকিয়ে উপরে দিকে উঠতে শুরু করেছে। অসম্ভব ভয় লাগছে আমার। বাড়ির বাকি সদস্যদের সঙ্গী করার উপায় নেই! ঘড়াটা যদি সোলেমানী ঘড়া হয় তাহলে আমি সবার জন্য বিরাট বিপদ ডেকে এনেছি! নাহ! তা কি করে হয়! ঘড়াটার বয়স যত দূর বুঝতে পারছি, দুইশত বছরের বেশি হবে না।

নিজের চিন্তায় মশগুল ছিলাম । অন্য কারো উপস্থিতি অনুভব করতেই চমকে ঘুরে তাকালাম। এ বাবা! এটা আবার কে? বছর তিরিশেকের বেশি হবে না লোকটার বয়স।গিলে করা ফিনফিনে পান্জাবী, চুড়িদার আর পায়ে নাগড়াই। মাথাভর্তি একঝাকড়া চুল আর মুখে চাপ কালো দাড়ি। চিলেকোঠায় তো অন্য কারো থাকার কথা নয়,দরজার চাবি তো আমার কাছেই থাকে! ভয়ে বেশ দিশেহারা হয়ে পড়েছি! হাতের কাছে একটা পাইপ পেয়ে ওটা হাতে নিয়েই মরিয়া হয়ে মারমুখী হয়ে দাঁড়িয়েছি! ‘আসসালামু আলাইকুম, শাহজাদী বিলকিস বেগম! আপনি এরকম পোশাক পরে আছেন কেন? এরকম বেআব্রু হয়ে আপনি যত্র তত্র ঘুরে বেরাচ্ছেন এটা ঠিক নয় । আপনি আপনার ভ্রমর কালো চুলের একি দশা করেছেন!’

ততক্ষণে আমার রাগ ব্রম্ক্ষতালু ছুঁয়েছে। বললাম, ‘সংযত হয়ে কথা বলুন, আমি বিলকিস বেগম নই।’

-‘তাহলে আপনি কে?’

-আমি কে তা আপনার না জানলেও চলবে , এই চিলেকোঠায় আপনি কিভাবে এলেন?’

লোকটাকে বেশ হতচকিত দেখাচ্ছে।

-‘আমি ওই ঘড়াটার মধ্যে বন্দী ছিলাম,আপনি ঘড়ার মুখটা খুলে দিলেন আর আমি বের হয়ে পড়লাম।’

ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি কি ভুলই না করেছি আমি।নিজে হাতে ‘জ্বীন্ִ’ ডেকে এনেছি। মনে মনে নিজেকে সাহস যোগাচ্ছি-সামাল দিতে হবে।

প্রশ্ন করলাম, ‘কে আপনাকে বন্দী করেছিল?’

-‘সন্দেশজাদী’

মনে পড়ল সন্দেশজাদী আমার পূর্বসুরীদের একজন ছিলেন, আর শাহজাদী বিলকিস বেগম তাঁর কনিষ্ঠা কন্যার নাম।

জ্বীন তাড়ানোর উপায় আমার জানা নেই কিন্তু একে তো তাড়াতে হবে। আল্লাহ ভরসা, কোনো না কোনো একটা উপায় বের হয়ে আসবেই। আপাতত কথা চালিয়ে যাই ওর সাথে। ভুলিয়ে ভালিয়ে যদি বিদায় করা যায়…

-‘আপনার চেহারার সাথে সন্দেশজাদীর চেহারার মিল খুঁজে পাচ্ছি । আপনি সন্দেশজাদী নন তো?’

বেশ ভীত শোনালো লোকটার গলা।

‘না আমি সন্দেশজাদী নই। আমি ওনার বংশধর। উনি প্রায় একশ আশি বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন।’

হতভম্ব দেখালো লোকটাকে।

আবারও প্রশ্ন করলাম,’ কে বন্দী করেছিল আপনাকে?’

-‘সন্দেশজাদী। শাহজাদী বিলকিস বেগম কোথায়? আর আমি কত বছর বন্দী ছিলাম?’

শাহজাদী অনেক আগেই মারা গিয়েছেন।’ .

ধেড়ে লোকটার ভেউ ভেউ কান্না শুরু হাওয়ায় অন্য প্রশ্নের সুযোগই পেলাম না। জ্বীনের চোখে জল; দেখার মত বিষয়! কান্নার প্রকোপ একটু থামতেই আবার প্রশ্ন করতে শুরু করলাম।

-‘কেন বন্দী করা হয়েছিল আপনাকে?’

-‘বিলকিস বেগমের প্রতি আসক্ত হয়েছিলাম তাই! আমার ‘হতে পারত শাশুড়ী আম্মা’ বেশ রাগী ছিলেন।’

-‘খুলে বলুন।’

– ‘আমি পেশায় বাবুর্চি। কোহেকাফের প্রধান মন্ত্রির বাবুর্চি ছিলাম। একদিন রান্নায় স্বাদ বাড়ানোর জন্য লতা গুল্মর খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, হঠাৎ সন্দেশজাদীর বাগানের দিকে নজর পড়ে। বাগানে শাহজাদী বিলকিস বেগমকেও দেখি। আহা কি রূপ! যেন ঝিনুক খোলায় রামধনু রঙা মুক্তা… ভ্রমর কালো…’

-‘রূপের বর্ণণা এখন থাক। আসল কথায় চলে আসুন।’

সন্দেশজাদীর মত দেখতে হওয়ার কারণে লোকটা মনে হয় আমাকে একটু ভয় পাচ্ছে; আর আমি তো প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে কথা বলে চলেছি।

বলেই ফেলল, ‘আপনি আমাকে তুমি করেই বলেন, আপনি আমার মাতৃতুল্য।’

‘আপনার মাতৃতুল্য হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই, তবে আমি আপনাকে তুমি করেই বলব । এখন বল, তুমি শাহজাদী বিলকিসের সাথে কি করেছিলে? তোমার নামটা এখনও জানতে পারিনি।’

-‘আমার নাম ‘দোউখানু নিয়ামি পাকড়াশ’। বিলকিস বেগমের রূপে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই, আহা কি তার রূপ, কি তার গুন । আমি শুধু তার পাশে পাশে থাকতে চাইতাম। কোহেকাফে না ফিরে ওই বাড়িতেই রয়ে গেলাম । ছয় মাস চেষ্টার পর বিলকিস বেগমও আমার প্রতি আকৃষ্ট হন, আর এই ঘটনাতে আমার ‘হতে পারত শাশুড়ী আম্মা” রেগে গিয়ে আমাকে ঘড়া বন্দী করেন।’

বিলকিস বেগমকে নিয়ে বেশ গর্বিত বোধ করছি, বিলকিস বেগমের সাহসিকতায় আমি মুগ্ধ।মানুষ হয়ে জ্বীনের প্রেমাসক্ত! দোউখানু প্রতিও বেশ টান অনুভব করছি। হাজার হোক আমার পূর্ব পুরুষের প্রেমিক।

বললাম, ‘তুমি তো এখন মুক্ত, কোহেকাফে ফিরে যাও।’

বিব্রত দেখাচ্ছে দোউখানুকে।



-‘সন্দেশজাদী আম্মা, আমার যে কোহেকাফে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই! কোহেকাফে বেকার লোকদের কোনো জায়্গা নেই।তার উপর আমার প্রাক্তন প্রেমিকা ওখানে আছে। কে জানে আমাকে ঝাটা পেটা করবে কিনা! বেকারদের কোহেকাফ থেকে বের করে দেওয়া হয়, তখন ওর আপনাদের আশে পাশে এসে আস্তানা গাড়ে আর আপনাদেরকে ভয় দেখায়।বিশ্বাস করুন আমরা জ্বীনেরা সবাই খারাপ নই! ‘

খুবই ম্রিয়মান দেখালো দোউখানুকে। সন্দেশজাদী আম্মা বলে ডাকার জন্য ওর উপর রাগ করতেও ভুলে গেলাম।

-‘ও সন্দেশ আম্মা, আপনি আমাকে কয়েকদিন আপনার বাড়িতে থাকতে দেন, আমি খুব ভালো রাঁধতে পারি, আপনার রান্না আমি করে দেব। এর মধ্যে আমি কোহেকাফের সাথে কথা বলে একটা চাকুরীর ব্যবস্থা করে ফেলবো আর আমার প্রাক্তন প্রেমিকাকেও বুঝিয়ে বলব।’

কি বলবে প্রাক্তনকে? ‘

-‘বলব, জ্বীন মাত্রই ভুল করে।’

মন্দ বলেনি পাকড়াশ! আজ কালের মধ্যে বাড়ীতে একটা বড় নৈশভোজের আয়োজন করতে হবে।বেশ চিন্তায় আছি আমি।মনে মনে বললাম,’বেটা বাবুর্চি! বিলকিস বেগমের সাথে প্রেম করতে গিয়েছিলি! বামুন হয়ে চাঁদে হাত! তোকে আমি বাবুর্চীর কাজই করাব!’

-‘ঠিক আছে তুমি বাবুর্চী পদে বহাল হলে, তবে মাত্র সাত দিনের জন্য। এই সাত দিনের মধ্যে দু’টো ছোট খাটো বিয়ে বাড়ি সমান নৈশভোজের আয়োজন সামাল দিতে হবে। আজ তুমি এই চিলেকোঠায় রয়ে যাও, কাল তোমার জয়েনিং। ওহো! তোমাকে আমি পাকু মিয়া বলে ডাকব।’ খুব ভোরে নিচে আমার রান্নাঘরে এসো, আমি বুঝিয়ে বলব কিভাবে কাজ করতে হবে।

দোউখানু চিঁ চিঁ গলায় বলে উঠল,-‘ও সন্দেশ মা,দয়া করুন , এই চিলেকোঠায় আমি একা থাকতে পারব না!’

অগত্যা দোউখানুকে সাথে নিয়েই নিচে নামতে হলো!

1 Comments

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post